মাদার তেরেসা জীবনী
প্রকৃত নাম | অ্যাগনেস গঞ্জা বোজাঝিউ |
জন্ম | ২৭ আগস্ট ১৯১০ সাল |
জন্মস্থান | ইউস্কুপ, অটোম্যান সাম্রাজ্য |
পিতার নাম | নিকোলাস বোজাঝিউ |
মাতার নাম | দ্রোনাফাইল বোজাঝিউ |
ধর্ম | ক্যাথলিক খ্রিস্টান |
পেশা | ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী, ধর্মপ্রচারক |
মৃত্যু | ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সাল |
ভূমিকা:
মানব মুক্তি এবং কল্যাণের মুর্ত প্রতি হিসেবে যারা এই দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে মাদার টেরেজা অন্যতম! মানুষকে নিপীড়ন দুঃখ এবং শাসনের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যে সকল সাধু সন্ন্যাসী ও সন্তরা নিজেদের জীবন জনগণের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন এবং সারা জীবন নিজেরা কষ্ট করেছেন, তাঁদের মধ্যে মাদার টেরেজা/মাদার তেরেসা হলেন শেষ উত্তরাধিকারী। আজ আমরা এই মহান আত্মাকে নিয়ে আলোচনা করব! আলোচনা করার আগে মাদার টেরেজার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু ধারণা তুলে ধরা হলো।
প্রথম জীবন:
১৯১০ সালে ২৬শে আগস্ট আলবেনিয়াতে এক ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাদার টেরেজা। পিতা ছিলেন নিকোলাস বোজাঝিউ নামের এক কৃষক ও মাতা দ্রোনাফাইল বোজাঝিউ। জন্মসূত্রে পাওয়া নাম ছিলো অ্যাগনেস। এই ছোট্ট মেয়েটির গরীব মা-বাবা কোনদিনও ভাবতে পারেনি যে একদিন তাদের এই ছোট্ট মেয়ে বড় হয়ে পৃথিবীর সবার দুঃখমোচন করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করবে! ছোট্ট অ্যাগনেস করুণাময় যীশু এবং মাতা মেরির মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে সকল মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য প্রার্থনা করতেন সেটি ছিল তাদের অজানা। এইভাবে প্রার্থনা করতে করতে একদিন নিজেই বেরিয়ে পড়েন মানুষের দুঃখ মোজন করার জন্য এবং ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় মাদার টেরেজা, সকলের মা!
অ্যাগনেসরা ছিলেন দুই বোন ও এক ভাই, জন্ম থেকেই এই ছোট্ট মেয়েটির ছিল একটি পা কৃশ। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতার জন্য তিনি সবসময় নিজেকে লজ্জার আবরণে ঢেকে রাখতেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে অ্যাগনেস পিতৃহারা হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষত বিক্ষত যুগস্লোভিয়াতে তিনটি শিশুকে অনেক কষ্টে লালন পালন করেন তাদের মা। মায়ের অনুপ্রেরণা তেই খুব কম বয়স থেকে দুর্ভিক্ষ এবং কষ্টে জর্জরিত মানুষদের দুঃখমোচনের জন্য আকৃষ্ট হন ছোট্ট অ্যাগনেস।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
প্রথম জীবনে স্থানীয় সরকারি স্কুলেই নিজের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন অ্যাগনেস ও পরে নিজের পিতৃভূমিতেই বাকি শিক্ষা সম্পন্ন করেন। প্রথমে তিনি এখানেই শিক্ষিকা হিসেবে সেন্ট মার্গারেট স্কুলে অংশগ্রহণ করেন এবং মাত্র তিনটি শিশুকে নিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে মাদার ভারতে আসেন। ১৮ বছর বয়স থেকেই তিনি নিজেকে মানুষের সেবার কাজে বিলিয়ে দেন। এরপর কলকাতার এন্টালিতে সেন্ট মেরিজ হাইস্কুলে ভূগোল শিক্ষিকা হিসাবে কাজ শুরু করেন পরে লরেটো স্কুলেও যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার প্রাককালে ভারতীয় নাগরিকত্ব পান। এখানে থাকা অবস্থায় পঞ্চাশের মন্বন্তর, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শহরে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ আর মৃত্যুর মিছিল যা মাদার টেরেজার মনে এনেছেন গভীর ক্ষত! সিস্টার অ্যাগনেস এই সময়েই শুরু করলেন তাঁর কাজ । অচিরেই তিনি বুঝতে পারলেন পেছনে বঙ্গন রেখে দরিদ্র ‘ আর্তের সেবা হয়। এখানকার অতি দীন ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে ‘ আশা–ভরসার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াতে হলে তাকে চার দেওয়ালের গণ্ডির নিশ্চিত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মাদার টেরেজার বাণী:
১৯৪৬ সালের ১০ ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিং যাওয়ার সময় এক অলৌকিক উপলব্ধি হল তার । মাদার টেরেজা যেন ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ শুনতে পেলেন । এই উপলব্ধি নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন,”…a call within a call……The message was clear. I was to leave the convent and help the poor, while living among them!” আমৃত্যু তিনি দরিদ্র o নিপীড়িত মানুষের সেবার কাজে নিযুক্ত থেকেছেন। তিনি মনে করতেন যে, গরিবের সেবা করতে হলে গরিব হয়ে তাদের মধ্যে থেকেই তা করতে হবে। ঈশ্বরের এই আদেশ লাভের দিনটিকে আমৃত্যু স্মরণ করতেন মাদার। তিনি বলতেন “দ্য ডে অব ডিসিশন”(The Day of Decision) — অর্থাৎ অনুপ্রেরণার দিন।
মাদারের প্রতিষ্ঠা:
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘ডায়োসিসান ধর্মপ্রচারকদের সংঘ’ করার জন্য ভ্যাটিকানের অনুমতি লাভ করেন। এই সংঘই পরবর্তীতে ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটি’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার মতিঝিল বস্তির দুঃস্থ ও দুর্গত মানুষদের দেখে হতদরিদ্র এবং দুরারোগ্য মানুষদের আশ্রয় ও চিকিৎসা দিতে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কালীঘাটে এক পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে ‘কালীঘাট হোম ফর দ্যা ডাইং’এ রূপান্তরিত করেন, পরবর্তীতে ইহার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘নির্মল হৃদয়’। এসময়ই মাদার টেরেসা টিটাগড়ে কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম দেন ‘শান্তি নগর’। তিনি মিশনারিস অফ চ্যারিটির উদ্যোগে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেন। এছাড়াও অনাথ শিশুদের লালন পালন করতেন এবং তাদের জন্য থাকার জন্য ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘নির্মল শিশু ভবন’ স্থাপন করেন যা বসতিহীন শিশুদের কাছে এনে দিয়েছিল একধরণের স্বর্গ।
দয়াময়ী মাদার টেরেজা:
নীল পাড় যুক্ত সাদা সুতির শাড়ি পরিধান করে তিনি বাম কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন পবিত্র ক্রুশ চিহ্ন । ১৯৫০ সালে গঠিত হল “মিশনারিজ অফ চ্যারিটি”। মহামান্য পোপ তাঁকে দিলেন সানন্দ স্বীকৃতি । ১৯৫৪ সালে মহাতীর্থ কালীঘাটে স্থাপিত হল ‘নির্মল হৃদয়’- মুমূর্ষু সদন। সেসব অসহায়, নিরাশ্রয় নরনারী মৃত্যু পথযাত্রী, তাঁরা যাতে শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে কিংবা পেতে পারেন নবজীবনের ঠিকানা সেজন্যই এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। অর্ধলক্ষাধিক মানুষ আজ পর্যন্ত সেখানে লাভ করেছে করুণাময়ী জননীর স্নেহশীতল করস্পর্শ, পেয়েছে পরিচ্ছন্ন শয্যা, থালাভরা খাদ্য এবং সস্নেহ শুশ্রুষা।
i) এই করুণাময়ী জননীর স্পর্শ বর্তমানে ছড়িয়ে আছে ভারতের পঁয়ত্রিশটি শহরে, গঞ্জে এবং ভারতের বাইরে এবং পৃথিবীর নানা বিন্দুতে। এক বিশাল সেবিকা বাহিনী, বিশাল সেবাকর্মীর দল তার নেতৃত্বে মানবতার সেবার জন্য উৎসর্গকৃত-জীবন। সেই সময় টিটাগড়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য তিনি একটি আশ্রম খুলেছিলেন যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শান্তিনগর’। এছাড়া মিশনারিস অফ চ্যারিটি উদ্যোগ গ্রহণ করে কলকাতার বাইরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র ও স্থাপন করে। এই কেন্দ্রগুলোতে ঔষধ, ব্যান্ডেজ ও খাদ্য সুবিধা দেয়া হয়। ভারতবর্ষে তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিল ৬০ টি স্কুল,২১৩ টি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ৫৪ টি কুষ্ঠ চিকিৎসাকেন্দ্র।
ii) ভারতের বাইরেও তার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে। ১৯৬৫ সালে দরিদ্রদের জন্য ভারতের বাইরে প্রথম আশ্রম ঠিক হলেন ভেনিজুয়েলায়। ১৯৭১ সালের মিশনারি কর্মকাণ্ডের জন্য নিউইয়র্কে একটি আশ্রম করেন। এখন এই মুহূর্তে পৃথিবীর জুড়ে ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’তে চার হাজারেরও বেশি সন্ন্যাসিনি এবং লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে চলেছেন। মাত্র পাঁচ জন সন্ন্যাসিনী কে নিয়ে যে কেন্দ্র স্থাপন হয়েছিল তার খ্যাতি এবং সেবা চারিদিকে এখন ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া ও অস্ট্রিয়া এবং ১৯৭০ এর সময় এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে এর শাখা বিস্তারিত হয়ে থাকে।
মাদার টেরেজার সমস্ত পুরস্কার:
মাদার টেরেজার খ্যাতি যে শুধুমাত্র ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ছিল তা বলার বাহুল্য রাখে না। সেবা ধর্ম-কর্মের জন্য ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ পান ও ১৯৮০ তে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। নোবেল ও ভারতরত্ন পুরস্কার ছাড়াও তিনি পেয়েছেন ১৯৬২ তে ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’, ১৯৭২ তে ‘নেহেরু পুরস্কার’, ১৯৭৮ তে পেয়েছিলেন ‘বালজান পুরস্কার’ ও ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রীডম’। এছাড়াও বিশ্বভারতীর ‘দেশিকত্তম উপাধি’ এবং ভ্যাটিকান সিটির ২৩তম পোপ জন পুরস্কার পান।
বার্ধক্য জীবন ও প্রয়াণ:
আত্মমানুষের নিঃস্বার্থ সেবা ও অক্লান্ত কর্মপ্রচেষ্টার পরও তার বার্ধক্য জীবন মোটেও সুখদায়ক ছিল না। ১৯৮৩ সালে পোপ জনপল (ii) এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবারও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটি’র প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। ১৯৯৭ সালের ১৩ই মার্চ ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের’ পদ থেকে সরে দাড়ান। ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মাদারের ‘সন্ত’ উপাধি প্রাপ্তি:
৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তে রোমের ভ্যাটিকান শহরে বিশ্বের বহু মানুষের উপস্থিতিতে পোপ মাদার টেরেজাকে ‘সন্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেন। মনিকা বেসরা কে কেন্দ্র করে অলৌকিক কাণ্ডের জন্য ও অন্যান্য কারণে অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী মাদারকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন পোপ। এরপর থেকেই মাদার টেরেসা হয়ে গেলেন ‘সন্ত ‘টেরিজা। তাঁর সেবাও মানবতার যথার্থ উপহার তাঁকে সন্ত রূপেই প্রতিপন্ন করেছিল; পোপ এটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মাত্র।
উপসংহার:
মাদার টেরেজার সুকোমল হৃদয় যেন একটি ফুলের মতোই পবিত্র এবং বর্ণময়! তিনি নিজের জীবনকে অপরের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন যার সুবাস সুদূর প্রসারিত। মাদার টেরেজা তার মাতৃহৃদয় দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে হিংসা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মানুষের হৃদয়ে ধর্ম ও মনুষ্যত্ববোধ অনেক ঊর্ধ্বে। তাই তাঁর সেবা, শান্তি ও করুণা আজ বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত সবদিক দিয়ে। তিনি এক মূর্তিমতী জীবন্ত বিগ্রহ। তিনি যে সকলের মা, আমাদের সকলের প্রাণের মা!