Homeজীবনীলতা মঙ্গেশকর জীবনী | Lata Mangeshkar Biography in Bengali

লতা মঙ্গেশকর জীবনী | Lata Mangeshkar Biography in Bengali

সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের জীবনী

নাম: লতা মঙ্গেশকর
জন্ম: ১৯২৯ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর
জন্মস্থান: ইন্দোর, মধ্যপ্রদেশ
পিতার নাম: দ্বীননাথ মঙ্গেশকর
মাতার নাম: শিবন্তি মঙ্গেশকর ওরফে সুধামতি
পেশা: সঙ্গীতশিল্পী
মৃত্যু: ২০২২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি
মৃতুস্থান: মুম্বাইয়ের হাসপাতাল

ভূমিকা:

লতা মঙ্গেশকর, ওরফে ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ ছিলেন এক কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। আজ তিনি আমাদের মধ্যে না থাকলেও, তাঁর গাওয়া গানের মাধ্যমে তিনি আমাদের মধ্যেই থাকবেন। কয়েক যুগ অবধি লতাজীর সমতুল্য কোনো সঙ্গীতশিল্পী খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সেই ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আজ আমরা আমাদের সকলের প্রিয় লতাজীর জীবন সম্পর্কে জানবো। তার আগে ওনার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ও পরিচয়:

ইন্দোরে শাস্ত্রীয় গায়ক ও নাট্য শিল্পী পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর এবং শেবন্তীর কোল আলো করে ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন স্বনামধন্য গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। অনেক ছোট বয়স থেকেই স্বনামধন্য গায়িকা নিজের বাবার কাছেই গান শেখা শুরু করে দিয়েছিলেন। লতাজীরা মোট পাঁচ ভাইবোন। বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে হলেন লতা মঙ্গেশকরের ছোট বোন। এছাড়াও বিখ্যাত এই গায়িকার দুই বোন ও একটি ছোট ভাই রয়েছে। দুই বোনের নাম হল, ঊষা মঙ্গেশকর ও মিনা মঙ্গেশকর এবং ছোট ভাইয়ের নাম হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ছোটবেলা থেকেই গান গাওয়ার শখ ছিল গায়িকার। কিন্তু বাড়ি থেকে গান গাওয়ার অনুমতি মিললেও সমস্ত গান শেখার অনুমতি মেলেনি তার। গায়িকার বাবা চাইতেন মেয়ে শুধু ধ্রুপদী গান করুক। আর সেই জন্যই ছোট বেলায় কে এল সায়গল ছাড়া আর কোন গান গাওয়ার অনুমতি মেলেনি তার।

লতাজীর সঙ্গীত শিক্ষার শুরু:

পাঁচ বছর বয়সে লতাকে তাঁর বাবার লেখা নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তাঁর সকল ভাইবোন – মীনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথ সঙ্গীত জগতের সঙ্গে জড়িত এবং সকলেই দক্ষ গায়ক এবং সঙ্গীতশিল্পী। ১৯৪২ সালে, তাঁর পিতার অকাল মৃত্যু ঘটলে তাঁর কাঁধে পরিবারের জন্য জোগানের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। তখন পণ্ডিত দীনানাথের এক বন্ধু মাস্টার বিনায়ক মঙ্গেশকর তাদের পরিবারের যত্ন নেন এবং তাঁকে বড়ি মা ছবিটিতে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাবও দেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪৯ সালে, তিনি বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান, এবং সেখানে তিনি ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন।

লতা মঙ্গেশকরের কর্মজীবন:

বোম্বাইয়ের ফিল্মিস্থান কর্ণধার, তৎকালীন এক মুভি-মুঘল শশধর মুখার্জির কাছে সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের হাত ধরে পঞ্চদর্শী কিশোরী লতা গিয়েছিলেন গান গাইবার সুযোগ পেতে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেদিন অসহায় পিতৃহারা কিশোরীকে ফিরতে হয়েছিলো শূন্য হাতে। তেরো বছরের কিশোরী লতাকে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেবার সূত্রে হায়দার লতাকে চিনতেন। তিনিই নিলেন অনুঘটকের ভূমিকা। গোলাম হায়দারের সঙ্গীত পরিচালনায় লতার রেকর্ডিঙে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দিকপাল সঙ্গীত পরিচালক খেমচন্দ্র প্রকাশ, নৌশাদ এবং অনিল বিশ্বাস। এই তিনজনই লতার সুরেলা কণ্ঠস্বর এবং গায়কীর স্বতঃস্ফূর্তিতে আকৃষ্ট হয়ে সুযোগ দিলেন নিজেদের সুরে গাইবার। শঙ্কর জয়কিষণ বরসাত ছবিতে মিরাকল করে দিলেন। এরপর এদের কাউকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় সকল সুরকারই বাঁধা পড়ে গেলেন লতাকণ্ঠের জাদুতে!

লতাজীর বিখ্যাত গানগুলি:

ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশ ‘ জিয়া বেকারার হ্যায় ’ উতলা করে দিয়েছিলো শ্রোতাদের মন পঞ্চান্নয় ‘ মন দোলে মেরা তন দোলে ‘ দুলিয়েছিলো সারা দেশের হৃদয়, সাতান্নতে ‘ আজারে পরদেশী ‘ ডাক দিলো দুনিয়ার সঙ্গীত রসিকদেরকে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর। ক্রমাগত সুপার ডুপার হিট বহু গানের দৌলতে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রী মাথায় তুলে নিলো লতাজীকে। সঙ্গীত পরিচালকদেরও নয়নের মণি হয়ে উঠলেন তিনি। গানের ভাব অনুযায়ী গায়কীকে তৈরি করে নেবার আশ্চর্য দক্ষতা লতার। একই ছবিতে তিনজন নায়িকার কণ্ঠে গান গেয়েছেন লতা, গাইবার ভঙ্গী প্রতিক্ষেত্রেই পাল্টেনিয়ে। নার্গিসের মতো প্রায় প্রৌঢ় নায়িকার কণ্ঠে যিনি মানানসই, সেই লতার কণ্ঠ অবলীলায় মিলে যায় ‘ ববি’র কিশোরী ডিম্পলের সঙ্গে। শিশুকণ্ঠের গান, বিরহের বা উচ্ছ্বাসের গান, শিশুকে ঘুম পাড়ান মায়ের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান যাই হোক না কেন সিকোয়েন্সের সব পুরোপুরি মিটিয়ে প্রার্থিত ভাবটি অতি নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন কিন্নরকণ্ঠী লতা। লতা নিজেকে ফিল্মী গানে এমন অপরিহার্য করে তুলেছিলেন যে, শঙ্কর জয়কিষণ বলতেন ‘ লতাজীর হাঁচি হলে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির সর্দি লেগে যায়। হিন্দী সিনেমার গ্রেট শো-ম্যান রাজকাপুর বলেছেন ‘ আমরা সৌভাগ্যবান যে লতার সময় ছবি করতে পেরেছি। এমন প্রতিভা শতাব্দীতে একজন জন্মায় কি না সন্দেহ।‘

পুরস্কার ও স্বীকৃতি:

লতা মঙ্গেশকর নিজের আট দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে বেশ কিছু পুরস্কার এবং প্রশংসা পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৭৪ সালে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি অনেক পুরস্কার পান যার মধ্যে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫ টি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, এছাড়াও চারটি ফিল্মফেয়ার সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে ও দুটি ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডও পান সকলের প্রিয় ‘ভারতের নাইটেঙ্গেল’।
লতা মঙ্গেশকর ১৯৮৯ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারেও ভূষিত হন। আবার ২০০১ সালে, তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে তার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “অফিসার অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনার” প্রদান করে।
এছাড়াও লতা মঙ্গেশকর ১৯৭৪ সালে গিনেস রেকর্ডে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করা শিল্পী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ভারত সরকার তাকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর ৯০ তম জন্মদিনে ‘জাতির কন্যা’ পুরস্কারে সম্মানিত করে।
প্রখ্যাত গায়িকা সম্পর্কিত “লতা মঙ্গেশকর: একটি মিউজিক্যাল জার্নি” শিরোনামের বইটিতে ১৯৪০ এর দশক থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত হিন্দি সঙ্গীতের রানী হিসাবে সঙ্গীতজগতে কাটানো তাঁর জীবনের গল্প, সংগ্রাম, সাফল্য এবং রাজত্বের সাথে জড়িত অনেক অজানা তথ্য রয়েছে।

চলচ্চিত্র শিল্পে অবদান:

শুধু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে না, চলচ্চিত্রেও তাঁর যথেষ্ট অবদান আছে। তিনি মোট চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
i) ১৯৫৩ সালে মারাঠি চলচ্চিত্র ‘ভদাল’
ii) ১৯৫৩ সালে হিন্দি ছবি ‘ঝাঁঝার’
iii) ১৯৫৫ সালে হিন্দি ছবি ‘কাঞ্চনগঙ্গা’
iv) ১৯৯০ সালে হিন্দি ছবি ‘লেকিন’
বাংলা ভাষায় তিনি রেকর্ড করেছিলেন ২০০টি গান, যা আজও শ্রোতা মহলে প্রশংসিত হয়। তাঁর গাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাংলা গান হল: চঞ্চল মন আনমনা হয়, নিঝুম সন্ধায়, কে যেনো গো ডেকেছে আমায়, আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো, ইত্যাদি। এসব ছাড়াও তিনি হিন্দি গানের ক্ষেত্রে নিজের সুরের জাদু যেভাবে অধিষ্ঠিত করে গেছেন তা বহু কাল ধরে সকলের হৃদয় ছুঁয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও অনন্য হয়ে থাকবে।

অসুস্থতা ও প্রয়াণ:

শেষ বয়সে সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দেয়। সে কারণে ১১ নভেম্বর, ২০১৯-এ লতা মঙ্গেশকরকে দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তারপর, তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও, তার অবস্থায় তেমন প্রসার ঘটেনি। ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আইসোলেশনে বেশ কিছু দিন ছিলেন, শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপসংহার:

লতাজী এমন এক জায়গায় অবস্থান করছেন যে তিনি আজ না থাকলেও তাঁর গানের মাধ্যমে, সৃষ্টির মাধ্যমে যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। এই শিল্পীর শিল্পসত্তা বেঁচে থাকবে আমাদের মনে, প্রাণে ও জীবনে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

RELATED ARTICLES

Most Popular