আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনী
নাম: | জগদীশচন্দ্র বসু |
জন্ম: | ১৮৫৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর |
জন্মস্থান: | বিক্রমপুর |
পিতার নাম: | ভগবান চন্দ্র বসু |
মাতার নাম: | বামাসুন্দরী দেবী |
স্ত্রীর নাম: | অবলা বসু |
প্রতিষ্ঠান: | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: | সিআইই, সিএসএই, নাইট ব্যাচেলর |
মৃত্যু: | ১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর |
ভূমিকা:
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন পদার্থবিদ, কল্পবিদ্যার রচয়িতা এবং জীববিজ্ঞানী। মনে করা হয় যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় জগদীশচন্দ্র বসুর হাত ধরেই। ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স (Institute of Electronical and Electronics), জগদীশচন্দ্র বসুকে একজন রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক হিসেবে অভিহিত করে। প্রাচীনকালে ভারতে দর্শন বিজ্ঞান সাক্ষী হয়েছিল প্রভূত উন্নতির। কিন্তু পরবর্তীকালে অধঃপতিত জাতির দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে এসেছিল এক অবাঞ্ছিত বিচ্ছেদ আর সেই অবরুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন বিজ্ঞানের বরপুত্র আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু । তাঁর বিজ্ঞান সাধনার মাধ্যমেই প্রাচ্যের দর্শন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের নতুন সেতুবন্ধন হয়েছিল। আজ এই মহান বিজ্ঞানীকে নিয়েই আমরা আলোচনা করবো। তার আগে তাঁর ব্যাপারে একনজরে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
জন্ম ও পরিচিতি:
৩০ শে নভেম্বর ১৮৫৮ সালে বিক্রমপুর গ্রামে বিজ্ঞানমনষ্ক বরপুত্র জগদীশচন্দ্রের জন্ম । পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও মাতা বামাসুন্দরী দেবী গৃহবধূ। বাবার কঠোর অনুশাসন ও মায়ের কোমল মমতার ছোঁয়ায় তিনি বড়ো হয়েছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা:
পিতার স্বদেশানুরাগ ও স্বদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ এবং মায়ের দেওয়া রামায়ণ- মহাভারতের জ্ঞান জগদীশচন্দ্রের জীবনে সফলতার প্রথম ধাপ। শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় অধ্যয়নকালে সাধারণ মানুষের শিশুসন্তানদের ধ্যান ধারণা ও জ্ঞান অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি তাঁর জীবনপাত্র পূর্ণ করেছিলেন। শৈশবে সংগৃহীত শিল্পী কারিগরদের কর্মকুশলতা তাঁর জীবনে স্বার্থকতার আরেকটি সিঁড়ি।
পরের শিক্ষাজীবন:
জগদীশচন্দ্র বসুর স্কুলজীবন শুরু হয় ফরিদপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও পরবর্তীকালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে। যেহেতু তাঁর বাবার বদলির চাকরি ছিলো, তাই তাঁকেও স্কুলের বদলি করতে হয়েছিলো। ১৮৭০ সালে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৭৫ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৮৮০ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে বি.এ পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যাতে ট্রাইফস নিয়ে পাশ করেন। এরপর থেকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন।
জগদীশচন্দ্র বসুর কর্মজীবন:
জগদীশচন্দ্র বসু পড়াশুনা শেষ করে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিদ্যায় অধ্যাপনার চাকরি লাভ করেন ১৮৮৫ সালে।তিনি কলেজে পড়ানোর সময় পাঠ্যবিষয়কে বাস্তব পরীক্ষার সাহায্যে এমনভাবে প্রাণবন্ত করতে পারতেন যে তাতে তাঁর শিক্ষার্থী ছাত্ররা উৎসাহ পেত তাই নয় বরং মুগ্ধও হয়ে যেতাে। শুধু পড়ানোের দক্ষতায় নয়, তার ন্যায়নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা শত্রুকেও বশ মানাতাে এমনই ছিল তাঁর জাদুর ছোঁয়া অর্থাৎ মানুষকে বশ করার ক্ষমতা। ৩৫ বছর বয়সে তার জন্মদিনের এক উৎসবে তিনি নিজেকে পুরােপুরি বিজ্ঞানের সাধনায় নিয়ােজিত রাখার শপথ নিলেন। সেই সময় জগদীশচন্দ্রের জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে গিয়েছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি হারিয়েছেন তার পিতামাতাকে!
১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর বিদ্যুৎ বিষয়ক মৌলিক গবেষণার বিষয় লন্ডনের রয়াল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়।
বিবাহিত জীবন:
১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অবলা বসুর সাথে যিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে রওনা হন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে তাকে ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়। তাঁদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসুকে আর্থিক অনটনের এর মধ্যে কাটাতে হচ্ছিল। পরবর্তীকালে সৌভাগ্যক্রমে অবলা দেবী ও জগদীশচন্দ্র বহু কষ্টে এ মহাসংকট কাটিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন।
পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার:
ছোটো থেকে বিজ্ঞানমনস্ক জগদীশকে বিজ্ঞান নিকেতনের নানান গোপন রহস্য তাঁকে কোথাও থামতে দেয়নি। পরাধীন দেশের বৈজ্ঞানিক হওয়ার অভিশাপে তাঁকে বিজ্ঞান সাধনায় সহস্র দুঃখ অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছিল। তবুও তিনি দমে যান নি। অবশেষে অক্লান্ত গবেষণায় তাঁর হাতেই ঘটল বিজ্ঞানের নবনব রহস্যের দ্বারোদঘাটন! নবনব তথ্যের আবিষ্করণ! বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয় তাঁর আবিষ্কার তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠেরো মাসে জগদীশচন্দ্র বসু যে সকল গবেষণার কাজ সম্পাদিত করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভূষিত করেছিল ‘ডিএস-সি’ উপাধিতে। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের সম্ভাব্যতা স্বীকৃত হয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার ও তাঁকে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। তারপর ইউরোপের নানা দেশ থেকে তাঁর কাছে আসতে লাগল তাঁর গবেষণা বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বহু অনুরোধ। পাশ্চাত্য জাতিরা সেদিন সসম্ভ্রমে স্বীকার করে নিল সেই ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের মৌলিক আবিষ্কারের কথা; তিনি আর কেউ নন – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। বেতারযন্ত্রের আবিষ্কারকের সম্মান প্রকৃতপক্ষে জগদীশচন্দ্রের প্রাপ্য কিন্তু মার্কনি জগদীশ চন্দ্রকে অস্বীকার করে স্বয়ং লাভ করলেন সেই দুর্লভ মর্যাদা জগদীশচন্দ্র অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছিলেন – ” যাহারা আমার বিরুদ্ধ পক্ষে ছিলেন, তাহাদেরই একজন আমার আবিষ্কার পরে নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন”। জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সরস্বতীসাধনা এইভাবে ব্যথার সাধনা-দুঃখের সাধনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
উদ্ভিদবিদ্যায় বড়ো আবিষ্কার:
ইংল্যান্ডের রয়াল ইন্সটিটিউশনে জড় এবং জীবের মধ্যে সাড়ার বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেন। শুরু করেন উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণা। তিনি ক্যাম্বোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিস্কার করে সেই যন্ত্র দিয়ে প্রমান করে দেখান যে, গাছেদেরও প্রাণ আছে। মানুষ, পশু, পাখীদের মতো তাদেরও বৃদ্ধি, রোগ, জরা, মৃত্যু, ব্যাথা, কষ্ট আছে। আছে অনুভুতিও।
সাহিত্যের সৃষ্টি:
তিনি আধুনিক যুগের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে চরম অর্থকষ্টে পড়েন তিনি। আর তখনই বিজ্ঞানী বন্ধুর পাশে সাহাজ্যের হাত বাড়িয়ে দেন, সিস্টার নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ, ত্রিপুরার মহারাজা সহ আরও অনেকেই। উনার প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞানমন্দির আজ শুধু বাঙালি নয় সারা দেশের গর্ব। শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য চর্চাতেও তিনি ছিলেন এক মহান স্রষ্টা। সাহিত্যের সাধক ছিলেন তিনি। উনার রচিত গ্রন্থের নাম ‘অব্যাক্ত’। বাংলা সাহিত্য এবং বিজ্ঞানে তিনিই প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক সাহিত্য রচনা করেছেন। বাঙালির বিজ্ঞান সাধনাকে তিনি সারা পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
বিজ্ঞান মন্দিরের স্থাপন:
অধ্যাপনা বৃত্তি থেকে অবসর গ্রহণ করবার পর পরাধীন ভারতের বিজ্ঞানের গবেষণার দৈন্য দূর করবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর স্থাপন করেছিলেন “বসু বিজ্ঞান মন্দির’। তাঁর জীবনের উপার্জিত সমস্ত অর্থই এই গবেষণা মন্দিরের নির্মাণ ও উপকরণাদি ক্রয়ে ব্যয়িত হয়েছিল। অবশেষে বিজ্ঞানের কক্ষ কক্ষান্তরে বিচরণ করে তাঁর রহস্যপুরীর দুয়ার একে একে উন্মুক্ত উন্মুক্ত করে ভারতের বিপুল সম্ভাবনায় বিজ্ঞান সাধনায় দ্বারোদঘাটন করে ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতমাতার সুসন্তান এই বিশ্ব বিশ্রুত বিজ্ঞান -বীর পরলোক গমন করেন। কিন্তু ভারতের বিজ্ঞান লক্ষ্মীর পদতলে উৎসর্গীকৃত প্রাণ এই মহামনীষী তাঁর উত্তর-সাধকের জন্য বিজ্ঞান সাধনার যে একটি অনুকূল পরিবেশ রচনা করে গিয়েছেন তা ব্যর্থ হয়নি; তা ব্যর্থ হবার নয়। তাঁর বিজ্ঞানসাধনার পৃষ্ঠতলে বাংলার যেসব তরুণ বিজ্ঞানী ভিড় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও মেঘনাথ সাহা অন্যতম।
প্রয়াণ:
বার্ধক্যজনিত কারণে এই বিজ্ঞানীর শারিরীক অবনতি ঘটে ও ৭৮ বছর বয়সে ১৯৩৭ সালের ২০ শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুস্থান ছিল ব্রিটিশ ভারতের গিরিধাতে যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গিরিধা নগরী।
উপসংহার:
বিজ্ঞানমনষ্ক ও সরস্বতীর বরপুত্র জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন পরাধীন ভারতে এক শ্রেষ্ঠ কৃতি সন্তান। পরাধীনতার দুঃসহ জ্বালা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে দেশমাতৃকার শিরে মহিমার মুকুট পরাবার জন্য তিনি আজীবন যে বিজ্ঞান সাধনা করে গেছেন তা মানব জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাঁর বিজ্ঞান সাধনা ছিল দুঃখের সাধনা। দারিদ্র্য তাঁর পথ রোধ করতে পারেনি; পরাধীনতা পারেনি তাঁর মনোবলকে বিধ্বস্ত করতে। তাই স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব এই মহান বিজ্ঞান সাধকের সাধনাকে স্বার্থক রূপদান করবার। তিনি বিজ্ঞানের যে অদম্য তপস্যা করেছিলেন তা নবপ্রজন্ম বিজ্ঞান ব্রতীদের কাছে হয়ে উঠুক মহান আদর্শ স্বরূপ। জগদীশচন্দ্রের সেই দুঃখের সাধনা জাতির সকল স্বপ্নের মধ্যে লাভ করুক চরম সফলতা।