ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে গ্রাম। শহরের মতো গ্রামেও বহু সংখ্যক মানুষ বাস করেন। শহরাঞ্চলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে সবরকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। আবার অনেকে মনে করেন ব্যবসা করার জন্য সেরা জায়গা শহর। তবে বাস্তবে সেটিও সত্যি নয়। গ্রামে থেকেও আপনি ব্যবসা করতে পারবেন এবং হাজার হাজার টাকা উপার্জনও করতে পারবেন।
গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ। তবে অনেক মানুষেরই কৃষিকাজে আগ্রহ নেই, কোন একটি নিজের ব্যবসা শুরু করতে চান অনেকেই। তবে উপযুক্ত গাইড এবং মনের জোরের অভাবে সবার ক্ষেত্রে এটি সম্ভব হয় না। আজকাল সকলেই স্বাবলম্বী হতে চান, গ্রামে থেকেও স্টার্ট আপের মাধ্যমে আপনার ব্যবসা কে শূন্য থেকে শুরু করে হাজার বা লাখে পৌঁছে দিতে পারেন নিজেই। সঠিক উপায় অবলম্বন করলে এবং সঠিক জীবিকা বেছে নিলে সাফল্য ঠিকই আসবে।
আজকে এই প্রতিবেদনে আপনাদেরকে এমন ১১ টি ব্যবসার কথা বলব যেগুলি আপনি গ্রামে থেকে সহজেই করতে পারবেন এবং কিছুদিন পরিশ্রম করলেই তারপর হাজার হাজার, লাখ লাখ টাকা ইনকাম করতে পারবেন গ্রামে থেকেই। আপনি নিজের স্বাবলম্বী হবার পাশাপাশি আরো অনেক মানুষকে স্বাবলম্বী করতে পারবেন ব্যবসার মাধ্যমে।
গ্রামে কি ব্যবসা করা যায়?
গ্রামে অনেকধরনের ব্যবসা শুরু করা যায়। তবে আমরা আপনাদের জন্য সহজ এবং লাভজনক কিছু ব্যবসার কথা এখানে জানাবো। মনে রাখবেন যেকোনো ব্যবসা শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার এলাকার বাজার পরিস্থিতি গবেষণা (Market Research )করা উচিত।
কাচামালের ব্যবসা:
কাঁচামাল হিসেবে কাঁচা সবজি গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চল সবার কাছেই প্রিয়। তাজা এবং টাটকা শাকসবজি খেতে সকলেই পছন্দ করেন। এর চাহিদা কোনদিনই কমবে না, বরঞ্চ দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। তাই কাঁচামালের ব্যবসা করে আপনি খুব সহজেই লাভের মুখ দেখতে পাবেন।
গ্রামের দিকে বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ। তাই খুব সহজেই আপনি গ্রাম থেকে লাউ, টমেটো, কুমড়ো, বিভিন্ন রকম শাক, ফুলকপি বাঁধাকপি, উচ্ছে, বেগুন কিনে মজুত করতে পারবেন। কৃষকদের কাছ থেকে আপনি অল্প দামেই এগুলি সংগ্রহ করতে পারবেন। গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে কিনে আপনি শহরের বিভিন্ন কোম্পানি বা শহরের পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে এগুলো বিক্রি করতে পারবেন। চাইলে আপনি গ্রামেও খুচরা হিসেবে এগুলো বিক্রি করতে পারবেন।
মাত্র ৫ হাজার থেকে দশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেই আপনি এই ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। যতদিন যাবে ক্রমশই আপনি লাভের মুখ দেখবেন এবং লাভের অংক বাড়তে থাকবে।
সাইবার ক্যাফে খুলে ব্যবসা:
বর্তমানে প্রায় যাবতীয় কাজ অনলাইন এর মাধ্যমে করা হচ্ছে। বিভিন্ন রকম চাকরির ফর্ম ফিলাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনলাইন ছাড়া গতি নেই। শহরের বেশিরভাগ বাড়িতে এবং দোকানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট পরিষেবা থাকলেও গ্রামের দিকে কম্পিউটার, প্রিন্টার এগুলো সবার কাছে থাকে না। তাই গ্রামের দিকে কারো ফর্ম ফিলাপ বা কোন প্রকল্পের টাকা পেতে হলে তাদেরকে ছুটতে হয় দূরের কোন সাইবার ক্যাফে।
আপনি যদি একটি ছোট দোকান খুলে কম্পিউটার,প্রিন্টার এবং ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে সাইবার ক্যাফে খুলতে পারেন তবে খুব শীঘ্রই আপনি মোটা অংকের টাকা ইনকাম করতে পারবেন। এই কাজের ভবিষ্যৎ রয়েছে বেশ ভালোই। আগামী দিনে প্রায় সব কিছুই অনলাইনের মাধ্যমে হতে চলেছে। একটা বড় গ্রামের মধ্যে সবাই যদি আপনার উপরেই নির্ভরশীল হয়ে তাদের সমস্ত কাজ করে, সে ক্ষেত্রে আপনি খুব সহজেই অনেক টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
এই ব্যবসায়ী বিনিয়োগ বলতে আপনার একটি ছোট দোকান, কম্পিউটার এবং আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতির খরচ এবং ইন্টারনেট খরচ। এরপর শুধু মাত্র ইলেকট্রিক বিল টুকু যা খরচ হবে, বাকি পুরোটাই আপনার লাভের খাতায় যোগ হবে। এর সাথে যদি আপনি বিভিন্ন রকম বিল পেমেন্ট এবং মোবাইল রিচার্জ এর ব্যবস্থাও রাখেন দোকানে সেক্ষেত্রে আপনার ইনকাম আরো বাড়বে।
মুরগি পালনের সাথে মাছের চাষ:
মুরগি পালন এবং মাছ চাষ যদি আপনি একই সাথে করতে পারেন তবে আপনি খুব কম সময়েই দ্বিগুণ লাভের মুখ দেখতে পাবেন। একই জায়গায় পাশাপাশি যদি আপনি মুরগি এবং মাছ চাষ করেন সেক্ষেত্রে মুরগির বিষ্ঠা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে আপনার মাছের খাবার খরচাটিও বেঁচে যাবে।
মাছ এবং মাংসের চাহিদা বর্তমানে গ্রাম, শহর উভয় জায়গাতেই রয়েছে। এই চাহিদা যত দিন যাবে তত বৃদ্ধি পাবে।
উৎপাদিত মাছ এবং মুরগি আপনি গ্রামের মধ্যেও বিক্রি করতে পারেন বা শহরের বড় বড় জায়গাতেও বিক্রি করতে পারেন। খুব সহজেই আপনি প্রচুর লাভের মুখ দেখবেন এই ব্যবসার মাধ্যমে।
ফার্মেসির ব্যবসা বা ওষুধের দোকান:
আপনার যদি ফার্মেসি কোর্স করা থাকে এবং ওষুধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ আইডিয়া থাকে তবে আপনি গ্রামে ওষুধের দোকান বা ফার্মেসির ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর টাকা ইনকাম করতে পারবেন।
গ্রামাঞ্চলে সব মানুষেরই ওষুধের দরকার পড়ে। গ্রামে ভালো ফার্মেসি বসুতের দোকান সবসময় থাকে না এবং থাকলেও সবরকম ওষুধ পাওয়া যায় না। এর জন্য গ্রামের মানুষদের কে বাধ্য হয়ে শহরে ছুটতে হয়, ওষুধ আনার জন্য।
আপনি যদি গ্রামেই একটি ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি হলেন এবং বাইরে থেকে ডাক্তার এনে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করেন, সেক্ষেত্রে আপনি যথেষ্ট লাভবান হবেন এবং গ্রামের মানুষদেরও উপকার হবে।
কোয়েল পাখির ব্যবসা:
বর্তমানে কোয়েল পাখি জনপ্রিয় একটি পাখি। এই পাখির ডিম এবং মাংস খেতে বর্তমানে প্রায় সকলেই পছন্দ করে। এই পাখির ডিম এবং মাংসের চাহিদা প্রচুর। পাখির দামও খুব কম বাজারে। তাই যদি কোয়েল পাখির ব্যবসা শুরু করতে পারেন সে ক্ষেত্রে আপনি খুব সহজেই লাভের মুখ দেখবেন।
বাড়ির ছাদে বা খুব অল্প জায়গার মধ্যেই আপনি কোয়েল পাখি পালন করতে পারবেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই পাখি ডিম পাড়ে। পুষ্টিমান বেশি হওয়ার জন্য এবং দেখতে সুন্দর হবার কারণে এর ডিমের চাহিদা ব্যাপক।
মাশরুম চাষ:
গ্রাম এবং শহর উভয় জায়গাতেই মাশরুমের চাহিদা ব্যাপক। অনেক মানুষ এটি খেতে পছন্দ করেন। শহরাঞ্চলে মাশরুম চাষের কোন উপযুক্ত জায়গা না থাকায় গ্রামের থেকেই মাশরুম শহরে রপ্তানি করা হয়।
গ্রামাঞ্চলে মাশরুম চাষের অনুরূপ পরিবেশ পাওয়া যায়। মাশরুম চাষ করার জন্য আপনার জমিতে কাজ করতে হবে না বা পরিশ্রম করা লাগবে না অতটা। ঘরে বারান্দায় বা যে কোন ছোট জায়গাতেও আপনি মাশরুমের চাষ করতে পারবেন। এই চাষে বিনিয়োগের তুলনায় লাভের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। একবার মাশরুম উৎপাদিত হলে বিক্রি করা নিয়ে আপনার কোন চিন্তা করা লাগবে না। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম প্রত্যেক বাজারেই এর চাহিদা প্রচুর। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে আপনি ছোটভাবে এই ব্যবসা শুরু করতে পারেন। আবার বড় করে শুরু করতে গেলে ৫০০০০ থেকে ২লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও আপনি অনেক টাকার মুখ দেখতে পাবেন।
বিউটি পার্লারের ব্যবসা:
মূলত মহিলাদের জন্য বিউটি পার্লারের ব্যবসায় একটি লাভজনক এবং সম্মানজনক পেশা হতে পারে। প্রত্যেকেই চায় নিজেকে সুন্দর ভাবে মেলে ধরতে। শহরাঞ্চলে অনেক বিউটি পার্লার থাকলেও গ্রামের দিকে বিউটি পার্লারের সংখ্যা খুবই কম এবং নেই বললেই চলে। আপনি যদি বিউটিশিয়ান কোর্স করে গ্রামের মধ্যে বিউটি পার্লার খোলেন এবং লাভ রেখে গ্রাহকদের জন্য অল্প মূল্যে পরিষেবা দেন, খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রচুর গ্রাহক পেয়ে যাবেন আপনি। এছাড়া বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্ট বিক্রি করার মাধ্যমে আপনি দ্বিগুণ লাভ করতে পারবেন।
গ্রামের মেয়েদেরকে বিউটিশিয়ান কোর্স করিয়েও আপনি ইনকাম করতে পারবেন। এতে করে আপনারও উপার্জন হবে এবং গ্রামের কিছু মেয়েও স্বাবলম্বী হতে পারবে।
সার, বীজ ও কীটনাশক এর ব্যবসা:
গ্রামের মানুষদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। তাই কৃষি সংক্রান্ত ব্যবসা করলে আপনি খুব সহজেই প্রচুর গ্রাহক পেয়ে যাবেন।
চাষবাস করার জন্য প্রথমেই দরকার বীজ সার এবং কীটনাশকের। গ্রামে হাইব্রিড প্রজাতির বীজ পাওয়া যায় না। আপনি যদি শহর থেকে হাইব্রিড প্রজাতির বীজ কিনে এনে গ্রামে এসে বিক্রি করতে পারেন তবে আপনি খুব সহজেই লাভবান হবেন। এছাড়া গ্রামে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাবে খুব দ্রুত। এছাড়াও ফলনের মান বাড়াতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় জমিতে। গ্রামে ভালো কীটনাশক না পাওয়ার জন্য শহরে গিয়ে কীটনাশক আনতে হয় কৃষকদের। বীজ এবং সারের পাশাপাশি আপনি যদি কীটনাশক এর ও ব্যবসা শুরু করেন, গ্রামের মানুষদের তো উপকার হবেই – আপনিও খুব কম সময়েই হাজার হাজার টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবসা:
চাষবাস এবং কৃষি কাজের মতো গরু বা মহিষ পালন গ্রামাঞ্চলের অন্যতম একটি জীবিকা। গরু বা মহিষ পালন করলে আপনি যে দুধ পাবেন তা বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
শহরাঞ্চলে যে মিষ্টির রমরমা ব্যবসা চলে তা গ্রাম থেকে যাওয়া ছানার থেকেই হয়। দূর থেকে ছানা তৈরি করে আপনি সেটি শহরে বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন।
গ্রামে এবং শহরে উভয় জায়গাতেই দুধের চাহিদা ব্যাপক। বাড়িত গরু মহিষের দুধ আপনি গ্রামে বিক্রি করতে পারবেন আবার দুধের পরিমাণ অনেক হলে সেগুলি শহরে পাঠিয়েও অনেক টাকা উপার্জন করতে পারবেন।।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র:
গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্য স্কুলের ওপরে নির্ভর করে থাকে। ভালো কোন টিউশন টিচার বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গ্রামে খুব কম থাকে।
আপনি যদি টিউশন বা কম্পিউটার শিক্ষা দেবার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারেন তাহলে খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক ছাত্রছাত্রী আপনার কাছে শিখতে আসবে। টিউশনের পাশাপাশি অনেক কারিগরি শিক্ষা নিয়ে আপনি এগিয়ে যেতে পারেন। গ্রামাঞ্চলে ছেলেমেয়েদের সেলাই, কাঠের কাজ সহ অনেক রকম কারিগরি কাজে এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে তারা অনেক ভালোভাবে কাজ শিখে স্বাবলম্বী হতে পারবে
মোবাইলের দোকান:
গ্রামের দিকে প্রায় সকলের কাছেই বর্তমানে মোবাইল আছে। তবে মোবাইলের পার্টস সংক্রান্ত সমস্যা বা রিচার্জ করতে হলে অনেকেই এখন দূরের কোন দোকানে ছুটতে হয়। গ্রামের দিকে মোবাইল রিপেয়ারিং এর ভালো দোকান পাওয়া যায় না, মোবাইল ব্যবহারকারীদের থেকে তাই বাধ্য হয়েই দূরের কোন ভালো দোকানে বা শহরে ছুটতে হয়। গ্রামের দিকে সকলের মোবাইলে নেট ব্যাঙ্কিং না থাকায় রিচার্জ এর ক্ষেত্রে দোকানের উপরে নির্ভর করতে হয় সকলকে।
আপনি যদি একটি মোবাইল রিপেয়ারিং এবং রিচার্জ এর দোকান দিতে পারেন, আপনার গ্রাহক সংখ্যা কোন দিন কমবে না বরঞ্চ দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে।