ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী
নাম: | ইন্দিরা গান্ধী |
জন্ম: | ১৯১৭ সালের ১৯ শে নভেম্বর |
জন্মস্থান: | এলাহাবাদ, ভারত |
পিতার নাম: | জওহরলাল নেহেরু |
মাতার নাম: | কমলা নেহেরু |
স্বামীর নাম: | ফিরোজ গান্ধী |
পুত্রের নাম: | রাজিব গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী |
ধর্ম: | হিন্দু |
পুরস্কার: | ভারতরত্ন |
মৃত্যু: | ১৯৮৪ সালের ৩১ শে অক্টোবর |
ভূমিকা:
ভারতের চতুর্থ এবং এখনো পর্যন্ত প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী! গোটা পৃথিবীর কয়েকজন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অন্যতম। ভারতের প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ‘লৌহ মানবী’ বলে খ্যাত হন। দেশের জন্য তিনি নিঃস্বার্থ সেবা করে গেছেন সর্বদা এমনকি দেশের কাজের মাধ্যমেই শেষ অবধি নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো তাঁকে! আজ তাঁরই জীবনী নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। তার আগে তাঁর বিষয়ে কিছু জরুরি তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
জন্ম ও পরিচিতি:
শিশু ইন্দিরার জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ শে নভেম্বর, এলাহাবাদের এক কাশ্মীরি পরিবারে। পিতা জওহরলাল নেহেরু ও মাতা কমলা নেহেরুর একমাত্র সন্তান হলেন ইন্দিরা। ইন্দিরার এক ছোটো ভাই শিশু অবস্থায় মারা যান। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় অধিরাজ্য তথা পরে প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এলাহাবাদের বৃহৎ পারিবারিক এস্টেট আনন্দ ভবনে মা কমলা নেহেরুর সঙ্গে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। তাঁর শৈশব ছিল একাকীত্বে ভরা ও নিরানন্দময়। জওহরলাল নেহেরু রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিচালনায় বাইরে থাকতেন অথবা কারারুদ্ধ থাকতেন, অন্যদিকে কমলা নেহেরুও প্রায়শই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকতেন। পরবর্তীকালে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রয়াত হন। পিতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রক্ষিত হত প্রধানত চিঠিপত্রের মাধ্যমেই।
ইন্দিরা গান্ধীর ছাত্রাবস্থা:
ইন্দিরা প্রধানত বাড়িতেই গৃহশিক্ষকদের নিকট শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি পড়াশোনা করেন দিল্লির মডার্ন স্কুল, এলাহাবাদের সেন্ট সিসিলিয়া’জ ও সেন্ট মেরি’জ ক্রিস্টিয়ান কনভেন্ট স্কুল, জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বেক্সের একোল নউভেল এবং অধুনা মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত পুণা ও বোম্বাইয়ের পিউপিল’স অন স্কুলে।
তিনি ও তাঁর মা কমলা নেহেরু কিছুকাল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠে বাস করেন। সেখানে ইন্দিরার অভিভাবক ছিলেন ‘স্বামী রঙ্গনাথানন্দ’।এছাড়া তিনি কিছুকাল শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতেও পড়াশোনা করেছিলেন, যা ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় রবীন্দ্রনাথই তাঁর নাম ‘প্রিয়দর্শিনী’ রাখেন এবং ইন্দিরা পরিচিত হন ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু’ নামে।
ইন্দিরা গান্ধীর কর্মজীবন:
জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ পারিবারিক পরিবেশে লালিত হয়ে এবং পিতা জওহরলালের উৎসাহে বাল্যবয়স থেকে ইন্দিরার মনে স্বদেশ প্রীতির বীজ রােপিত হয়। ১২ বছর বয়সে ১৯৩০ খ্রিঃ তিনি ‘ চরকা সংঘ ‘ গঠন করেন। পরে প্রায় ৬০০০ ছেলেমেয়ে নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের কিশাের বাহিনী ‘ বানর সেনা ‘ সৃষ্টি করেন।
পিতার মৃত্যুর পরে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে ও সকলের মতামতে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরে ইন্দিরা গান্ধীর জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে। যেমন,-
i) ইন্দিরার বিবাহিত জীবন:
১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে তিনি দিল্লির দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে কাজ করেছিলেন। ব্রিটেনে থাকাকালীন ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর ভাবী স্বামী ফিরোজ গান্ধীর প্রায়শই দেখা হত। ফিরোজকে ইন্দিরা এলাহাবাদ থেকেই চিনতেন। সেই সময় ফিরোজ লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসে পাঠরত ছিলেন। এলাহাবাদে দুই জনে ব্রাহ্ম মতে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যদিও ফিরোজ ছিলেন গুজরাতের এক জরথুস্ট্রবাদী পার্সি পরিবারের সন্তান। ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে ইন্দিরা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ।
ii) কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে যোগ:
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন ১৯৫৯ সালের। পরবর্তী এক বছর তিনি ঐ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আবার কংগ্রেস সভানেত্রী হন ১৯৭৮ সালে। ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে ইন্দিরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সেই সূত্রে ১৯৫৯ সালে কেরলের কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করায় তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই সরকার ছিল ভারতের প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার। ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর প্রে তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ক্যাবিনেটে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
iii) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও মহাকাশ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে কাজ:
ইন্দিরা গান্ধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭০-এর জুন থেকে ১৯৭৩-এর নভেম্বর পর্যন্ত। এছাড়া, মহাকাশ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন ১৯৭২-এর জুন থেকে ১৯৭৭-এর মার্চ পর্যন্ত। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিনি যোজনা কমিশনের চেয়ারপার্সনের দায়িত্বও পালন করে এসেছেন। পরে, ১৯৮০ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম এগারো বছরের শাসনকালে দেখা যায় কীভাবে তিনি কংগ্রেস নেতাদের ধারণায় তাঁদের ক্রীড়ানক থেকে এক শক্তিশালী নেত্রীতে উন্নীত হয়েছিলেন। তাঁর নীতিগত অবস্থানের জন্য কংগ্রেস বিভক্ত হয়। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি জয়ী হন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালের শেষে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে এমন এক প্রাধান্যবিস্তারকারী নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন যে কংগ্রেস সভাপতি ডি. কে. বড়ুয়া “ইন্দিরা’ই ভারত ও ভারত’ই ইন্দিরা” কথাটির প্রবর্তন ঘটান।
ইন্দিরা গান্ধীর ‘জরুরি অবস্থা’র জারি ও কংগ্রেসের গদি টলমল হওয়া:
১৯৭৫ খ্রিঃ ২৬ শে জুন ইন্দিরা গান্ধী সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারী করেন। ১৯৭৭ খ্রিঃ লােকসভার নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হন। ইন্দিরা গান্ধীর দলও শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয় । ফলে কেন্দ্রে ৩০ বছরের কংগ্রেসী শাসনের ছেদ ঘটে।
মােরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে জনতা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ খ্রিঃ ১ লা জানুয়ারী কংগ্রেস দল পুনরায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। শ্রীমতী গান্ধী কংগ্রেসের বৃহৎ গােষ্ঠীর নেতৃত্বে অবিচল থাকেন এবং তাঁর একান্ত অনুরাগীগণ এবং কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধী। তাঁকে চরম বিপদের দিনেও সর্বতােভাবে সাহায্য করতে থাকেন। তাদের আপ্রাণ চেষ্টা ও শ্রীমতী গান্ধীর প্রতি আনুকুল্য, স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর মনােবল, দৃঢ়তা ও জনতা সরকারের তীব্র অন্তর্ধম্বের ফলে ১৯৮০ খ্রিঃ লােকসভা নির্বাচনে শ্রীমতী গান্ধী স্বয়ং এবং তার দল জয়ী হয়ে কেন্দ্রে ফিরে আসেন।
ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু:
১৯৮১ খ্রিঃ কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর অকালমৃত্যু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। এই ঘটনার পরে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পরেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বপ্রকার সাহায্য করার কাজে এগিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে তিনি ফের শক্ত হন, ঠিক লোহার ন্যায়! তাই তো তাঁকে ‘লৌহ মানবী’ বলা হয়।
ভারতরত্ন প্রাপ্তি ও অন্যান্য পুরস্কার:
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৫ খ্রিঃ ইতালীয় ‘ইসাবেলা পুরস্কার’ এবং ১৯৭২ খ্রিঃ ‘ভারতরত্ন’ উপাধি লাভ করেন। শান্তিনিকেতন থেকে দেশিকোত্তম উপাধিতেও তাঁকে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ইন্দিরা গান্ধীকে দেশ ও বিদেশের বহু সম্মানজনক পদ ও উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আকস্মিক মৃত্যু:
সকালে তাড়াতাড়ি উঠে একটি সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে রওনা করার সময় ১৯৮৪ খ্রিঃ ৩১ শে অক্টোবর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সরকারী বাসভবনের প্রাঙ্গণেই দুজন উগ্রপন্থী শিখ দেহরক্ষী বিয়ান্ত সিং ও সতবম্ভসিং- এর গুলিতে নিহত হন। দুজন মিলে ঝাঁজরা করে দেয় তাঁর পুরো দেহ। রক্তে ভেসে যায় শরীর। তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। মৃত্যু ঘটে এই মহীয়সী নারীর। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সন্তান রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
উপসংহার:
ইন্দিরা গান্ধীর নাম ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। ইন্দিরা স্পষ্টতই তার দেশকে ভালোবাসতেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দেশকে একটি শক্তিশালী অবস্থানের মধ্যে রেখেছিলেন। তিনি ভারতের দরিদ্রতম এবং সমর্থিত শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জীবন উন্নত করতে চেয়েছিলেন। ভারতের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।