ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী
Bankim Chandra Chattopadhyay Biography in Bengali
নাম: | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
জন্ম: | ১৮৩৮ সালের ২৬ শে জুন |
পিতার নাম: | যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
মাতার নাম: | দুর্গা দেবী |
স্ত্রীর নাম: | মোহিনী দেবী ওরফে রাজলক্ষ্মী দেবী |
ছদ্মনাম: | কমলাকান্ত |
মৃত্যু: | ১৮৯৮ সালের ৮ ই এপ্রিল |
ভূমিকা:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও কবি। তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘বঙ্কিম রচনাবলী’র মাধ্যমে তিনি লেখার দ্বারা ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যতা সৃষ্টি করেছেন।
যে সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছিল ঘোর দুর্দিন ,অবহেলা ও অনাদরে যখন বাংলা সাহিত্য নিমজ্জিত প্রায় তখন, পরিত্রাতার মতো যিনি বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষাকে সেই চরম অধঃপতন ও অবমাননার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন ; তিনি আর কেউ নন- উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক এবং সমগ্র জাতির পথপ্রদর্শক। সারা জীবন তিনি সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
আজ সেই মহান ঔপন্যাসিককে নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করবো। তার আগে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
জন্ম ও পরিচিতি:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৬ শে জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫ বঙ্গাব্দে , বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটে অবস্থিত কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তাঁর পৈতৃক আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। রামহরি চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। পিতা যাদবচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর ।মাতার নাম দুর্গাসুন্দরী দেবী। বঙ্কিমচন্দ্রের মা তাঁর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বড় দুই ভাই হলেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়।
লেখকের শিক্ষা:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শৈশব বেলা থেকেই পড়াশোনার দিকথেকে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র একদিনের মধ্যেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা কাঁঠালপাড়া গ্রামে শুরু হলেও তা সেখানে সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি কাঁঠালপাড়া গ্রামে আট দশ মাস পড়াশোনা করার পর বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মেদিনীপুরে চলে আসেন এবং মেদিনীপুরেই তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মেদিনীপুরে পাঁচবছর ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করার পর তিনি কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। সেখানে তিনি শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নিতে শুরু করে দেন। তার পর ১৮৪৯ সালে হুগলী মহসিন কলজে ভর্তি হন এবং সেখানে আট বছরে জন্য পড়াশোনা জারি রাখেন। এর পর ১৮৫৬ সালে তিনি আইন পড়ার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দেন এবং কলেজের প্রথম দুজন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের চাকুরী ও বৈবাহিক জীবন:
পড়াশোনা শেষ করার পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরকারী চাকরী পেয়েছিলেন এবং বাবার মতো তাঁকেও বাংলার একটি জেলার ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। কিছুদিন বাদে তাঁর কর্ম দক্ষতা দেখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্কিমচন্দ্রকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত করে। প্রায় তিরিশ বছর তিনি ব্রিটিশদের অধিনে কাজ করেন এবং ১৮৯১ সালে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় আরো কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন –
জীবিকা সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন।ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর পদে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি অনবরত সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর সাথে দীনবন্ধু মিত্রের পরিচয় হয় যা পরবর্তীকালে অন্তরঙ্গতা লাভ করে। ছাত্রজীবনে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি নিজে পত্রিকা সম্পাদনার কাজ শুরু করেন যার নাম ছিল ‘বঙ্গদর্শন’ যেখানে তিনি একে একে দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ,সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করার পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের নানা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, নির্ভীক, কর্তব্যনিষ্ঠ ,দক্ষ শাসক ও সুবিচারক।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১১ বছর বয়সে নারায়নপুর গ্রামের মােহিনীদেবী নামক এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তার প্রথম বিয়ে করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত ১৮৫৯ সালে তার প্রথম স্ত্রী মারা যান। এর পর ১৮৬০ সালে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়।
সাহিত্যচর্চায় বঙ্কিম:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগের সঠিক প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে। তিনি ঐতিহাসিক ,সামাজিক, ব্যঙ্গ কৌতুক ,ধর্মীয়মূলক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন।তিনি তাঁর সাহিত্য সাধনার দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও পরে উপন্যাস, প্রহসন, নাটক ,প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখেছিলেন।বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেছিলেন বলে মানা হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছিল তাঁর লেখা প্রথম স্বার্থক বাংলা উপন্যাস।একে একে তিনি পনের টি উপন্যাসের জন্ম দেন যার মধ্যে একটি ইংরেজি উপন্যাসও ছিল। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’, ‘দেবীচৌধুরানি’, ‘আনন্দমঠ’, ‘সীতারাম’, ‘রজনী’, ‘বিষবৃক্ষ’,’কৃষ্ণকান্তের উইল’, ,’যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারানী’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এই উপন্যাসগুলোকে ঐতিহাসিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মতত্ত্ব প্রভাবিত প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তিনি ছিলেন খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ ‘,দেশবাসীর মধ্যে দেশপ্রেমের প্রেরণা জুগিয়েছিল।’আনন্দমঠে’, তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। ১৯৩৭ সালে এই গানটি কে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের তুলনায় তাঁর প্রবন্ধে সংস্থাগত গুরুত্ব বেশি। সেই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে- ‘লোক রহস্য ‘,’বিজ্ঞান রহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘বিবিধ সমালোচনা’, ‘সাম্য’, ‘প্রবন্ধ পুস্তক’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘শ্রীমদ ভগবতগীতা’ প্রভৃতি বৈচিত্রের দাবি রাখে।’কমলাকান্তের দপ্তর’ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এক অনন্যসাধারণ ব্যঙ্গাত্মক রচনা। ছদ্মনাম হিসেবে তিনি ‘কমলাকান্ত’ নামটিই নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন । তিনি ই প্রথম বাংলা ভাষাকে তাঁর প্রকৃত মর্যাদা দিয়েছিলেন।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা ‘বঙ্কিমী শৈলী’ বা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছে।
বঙ্কিমের কিছু বিখ্যাত উক্তি:
i) একজন স্ত্রী সতীত্ব সম্বন্ধে কোন দোষ করিলে সে আর মুখ দেখাইতে পারে না।
ii) একজন পুরুষ প্রকাশ্যে সেই সব কাজ করিয়া রোশনাই করিয়া জুড়ি হাকাইয়া রাত্রিশেষে পত্নীকে চরণরেণু স্পর্শ করাইয়া আসেন, পত্নী পুলকিত হয়েন।
iii) যাকে ভালবাস তাকে চোখের আড়াল করোনা।
iv) পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ!
বঙ্কিমের রাষ্ট্রগীত রচনা:
ব্রিটিশ বিরোধী গান ‘বন্দেমাতরম’ তাঁরই সৃষ্টি। যা সেই সময় বিপ্লবীদের মুখে মুখে ঘুরতো। ঋষি অরবিন্দ এই গানটিকে ‘বঙ্গদেশের জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই গানটি ছিলো যা বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে রচিত।
পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সম্মান:
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর ও কালেক্টরের পদের অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে ‘কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেন।
বঙ্কিমের দেহান্ত:
৮ ই এপ্রিল, ১৮৯৪ (২৬ শে চৈত্র ১৩০০ বঙ্গাব্দ) সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে তাঁর রচনাশৈলীর মাধ্যমে তিনি আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন।
উপসংহার:
সামগ্রিকতার বিচারে উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর প্রতিভা বলে বাংলা সাহিত্যের মরু প্রান্তরে পবিত্র মন্দাকিনী স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল।বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শৈশব অবস্থা থেকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু নামেই নয়, প্রকৃত অর্থেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘সাহিত্য সম্রাট’ ছিলেন। তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা ,দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনিই আমাদের মাতৃপূজার বোধন মন্ত্রের প্রথম বৈদিক ঋষি ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’!